মুক্তির দিশারী

মুক্তচিন্তার পথ প্রশস্ত করাই আমাদের লক্ষ্য।

দর্শন ধর্ম ফিকার্ড সংস্কৃতি

খিলজির বঙ্গ আক্রমণ এবং ভারতে শরিয়তী শাসন

ভূমিকা

প্রাগৌতিহাসিক সময় থেকেই প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া ও মিনোয়ান সভ্যতার সাথে সাথে সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে ওঠা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা সারা পৃথিবীর মানুষের আকর্ষণের বিষয়বস্তু ছিল। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবাঙ্গান, ধলাবিরা এবং রাখিগাড়ি সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নগর। এদের মধ্যে মহেঞ্জোদারো ঐ সময়ে পুরকৌশল ও নগর পরিকল্পনায় শ্রেষ্ঠ ছিল, যা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই অত্যন্ত লোভনীয় স্থান বলে বিবেচিত হতো। সেইসাথে হিন্দুস্থানের ঐশ্বর্য্য এবং ধনসম্পদের বিবরণ, তাদের কৃষিভূমি, এই অঞ্চলের নগর পরিকল্পনা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা অনেক অঞ্চলের জন্য ঈর্ষার বিষয় ছিল। সেই কারণেই বিভিন্ন সময়ে অ্যালেক্সান্ডার দ্যা গ্রেইট থেকে শুরু করে বড় বড় যুদ্ধবাজ রাজাগণ বারবার ভারত আক্রমণের চেষ্টা করেছে। সেই প্রাচীন আমলের রাজাবাদশা থেকে শুরু করে ইউরোপের আগ্রাসন, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বা পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের ভারতে উপনিবেশন স্থাপন, প্রায় সবসময়ই ভারতকে শোষণ করার এক অশুভ পরিকল্পনা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। আমরা প্রায়শই ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশ তৈরি এবং আমাদের ভারতের সম্পদ লুটপাটের জন্য দায়ী করি, অবশ্যই তারা এই অপরাধে অপরাধী। কিন্তু এর মধ্যে খুব কৌশলে ভারতে ইসলামি আগ্রাসনকে নিয়ে খুব বেশি আলাপ করা হয় না, কেউ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়। কারণ কোন দিক থেকে চাপাতির আক্রমণ শুরু হয়ে যায়, এই আশংকায় বেশিরভাগ শান্তিপ্রিয় মানুষই ভীত থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এটিই সত্য যে, এই অঞ্চলে তরবারির জোরে ইসলাম ভালভাবেই প্রবেশ করেছে। বেশীরভাগ মুসলিমই তাই ভারতে ইসলামী আগ্রাসনকে নানাভাবে জায়েজ করার চেষ্টা করে থাকে। শুধু তাই নয়, যেকোন বিরুদ্ধ মতকে ইসলাম ফোবিয়া সহ নানা উদ্ভট শব্দ দ্বারা এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন এই বিষয়ে কেউ কথা বলার সাহস না করে। এর সাথে যুক্ত হয় জবাই করার হুমকি। এই লেখাটিতে আমরা শুধুমাত্র ভারতে ইসলামী আগ্রাসন বিশেষ করে খিলজি ও তার পরবর্তী কিছু আক্রমণ, শাসন এবং বিধর্মীদের সম্পর্কে ইসলামের শরিয়তের বিধানবলী নিয়েই আলোচনা করবো। সেই সাথে এটিও আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাই আসলে ভারত, বিশেষত বাংলা বিহার উড়িষ্যা এই অঞ্চলগুলো আক্রমণ করেছে। সকল আগ্রাসনই, তা দেশি হোক বা বিদেশী, তা অন্যায়, যখন তা মানুষের জীবনের মূল্যে হয়। নিরাপরাধ বেসামরিক জনগণ যেখানে ভুক্তভোগী হয়। তাই আপনারা অমুক আগ্রাসনের কথা বললেন, তমুকের কথা কেন বললেন না, এগুলো যেকোন অপরাধ ঢাকার খুব সস্তা কৌশল। অন্য কোথাও ঘটা অন্যায় কোন অন্যায়কে ন্যায়ে পরিণত করে না, এই কথাটি মনে রেখে লেখাটি পড়তে হবে। অর্থাৎ, কলিমুদ্দীন দশটি ধর্ষণ করেছে, তাই রহিমুদ্দীনের আটটি ধর্ষণ জায়েজ হয়ে গেল, এমনটি নয়। দুইটি কাজই তখন অন্যায় এবং অপরাধ হবে।

ইসলামে ভারত আক্রমণের ফজিলত

ইসলামের নবী মুহাম্মদের জীবদ্দশাতেই মক্কায় একজন চিকিৎসকের কথা জানা যায়, যিনি ভারতের গুন্দেশপুর এসেছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য। সেই চিকিৎসকের নাম ছিল হারিস ইবনে কালাদা। তিনি মুহাম্মদের আমলের একজন আরব চিকিৎসক। অসংখ্য ইসলামিক গ্রন্থে তার সম্পর্কে কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, তবে বিস্তারিত জানা যায় না। এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, তিনি সেই সময়ে রীতিমত মানুষের চিকিৎসা করতেন এবং শরীর, স্বাস্থ্য, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ক পরামর্শ দিতেন এবং আলোচনা করতেন। আসুন উনার সম্পর্কে একটি ফতোয়া দেখি,

২১৯৯. প্রশ্ন
আমি একজন আলেমকে স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নিম্নোক্ত হাদীসটি বলতে শুনেছি।
المعدة بيت الداء، والحمية رأس الدواء، وأعط كل بدن ما عودته
(অর্থাৎ) উদর হল সর্বরোগের কেন্দ্র। আর খাদ্য-সংযম সর্বরোগের মহৌষধ। দেহকে তা-ই দাও, যাতে তাকে অভ্যস্ত করেছ। জানার বিষয় হল, এটি কি হাদীস। হাদীস হলে তা কোন কিতাবে আছে? জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তর
প্রশ্নোক্ত কথাটি কোথাও হাদীস হিসেবে উল্লেখেতি হলেও হাদীস বিশারদগণ বলেছেন, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়; বরং তা আরবের প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হারিস ইবনে কালদাহ-এর উক্তি।
অতএব তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না।
-আলমাকাসিদুল হাসানাহ পৃ. ৬১১; কাশফুল খাফা ২/৯৩; আদ্দুরারুল মুনতাছিরাহ ১৬৮; আল লাআলিল মানসুরাহ ১৪৫; আলফাওয়াইদুল মাজমূআহ ১৬৬; যাদুল মাসীর ৩/১৮৮; রুহুল মাআনী ৫/১১০; তাফসীরে কুরতুবী ৭/১৯২

শুধু তাই নয়, উনার সম্পর্কে কিছু জইফ হাদিসও পাওয়া যায়। জইফ হাদিসগুলো ( অর্থাৎ, এই হাদিসগুলোর বর্ণনাকারী রাবীদের ধারাবাহিকতায় কিছু ত্রুটি পাওয়া গেছে) সঠিক হয়ে থাকলে, মুহাম্মদ তার কাছে মানুষকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য পাঠাতেন বলেই মনে হয়। উনি গ্রীসের চিকিৎসকদের গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন বলেও কিছু কিছু সূত্র থেকে জানা যায়।

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব ২১: খাদ্য
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৪২২৪-[৬৬] সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক সময় আমি মারাত্মকভাবে পীড়িত হয়ে পড়লাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার খোঁজ-খবর নিতে তাশরিফ আনলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের হাতখানা আমার দু’ স্তনের মাঝখানে (বুকের উপর) রাখলেন। তাতে আমি আমার কলিজায় শীতলতা অনুভব করলাম। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি একজন হৃদ-বেদনার রোগী। সুতরাং তুমি সাক্বীফ গোত্রীয় হারিস ইবনু কালদাহ্-এর নিকট যাও। সে একজন চিকিৎসক। পরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে যেন অবশ্যই মদীনার সাতটি ‘আজওয়াহ্ খেজুর বীচিসহ পিষে তোমার মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। (আবূ দাঊদ)[1]
[1] য‘ঈফ : আবূ দাঊদ ৩৮৭৫, য‘ঈফুল জামি‘উস্ সগীর ২০৩৩, আল মু‘জামুল কাবীর লিতু ত্ববারানী ৫৩৪৬, য‘ঈফুল জামি‘ ২০৩৩।
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ হলো মুজাহিদ সা‘দ হতে বর্ণনা করাটা মুরসাল। আবূ যুর্‘আহ্ আর্ রাযী এমনটিই বলেছেন। বিস্তারিত দেখুন- ‘আওনুল মা‘বূদ ১০/২৫৫ পৃঃ, হাঃ ৩৮৭৫।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai’f)
বর্ণনাকারীঃ সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ)

সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২২/ চিকিৎসা
পরিচ্ছেদঃ ১২. আজওয়া খেজুর সম্পর্কে।
৩৮৩৫. ইসহাক ইবন ইসমাইল (রহঃ) …. সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একবার আমি পীড়িত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখার জন্য আসেন। এ সময় তিনি তাঁর হাত আমার বুকের উপর রাখলে আমি তাঁর শৈত্যতা আমার হৃদয়ে অনুভব করি। এরপর তিনি বলেনঃ তুমি হার্টের রুগী। কাজেই তুমি ছাকীফ গোত্রের অধিবাসী হারিছা ইবন কালদার নিকট যাও। কেননা, সে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। আর সে যেন মদীনার আজওয়া খেজুরের সাতটা খেজুর নিয়ে, তা বীচিসহ চূর্ণ করে তোমার জন্য তা দিয়ে সাতটি বড়ি তৈরী করে দেয়।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai’f)
বর্ণনাকারীঃ সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ)

একইসাথে সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদ তার অনুসারীদের হিন্দুস্থানের চন্দনকাঠ ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছিলেন। যা থেকে বোঝা যায়, ভারতের চন্দনকাঠ সেই সময়ে আরব অঞ্চলে খুব দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হিসেবে পরিগণিত হতো। তাই হিন্দুস্থানের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আরব অঞ্চলের মানুষের আগ্রহ ছিল, এটি মনে করা অস্বাভাবিক নয়।

সুনান আবূ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২২/ চিকিৎসা
পরিচ্ছেদঃ ১৩. আংগুল দিয়ে গলা দাবানো সম্পর্কে।
৩৮৩৭. মুসাদ্দাদ ও হামিদ ইবন ইয়াহইয়া (রহঃ) …. উম্মু কায়স বিনত মিহসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমি আমার এক ছেলেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হাযির হই; যার গলা (অসুখের কারণে) আমি মালিশ করেছিলাম। তখন তিনি বলেনঃ তোমরা তোমাদের সন্তানদের গলার আসুখে কেন তাদের গলা মালিশ কর? বরং তোমাদের উচিত (এ রোগের জন্য) হিন্দুস্থানের চন্দনকাঠ ব্যবহার করা। কেননা, তাতে সাত ধরনের রোগ ভাল হয়, যার একটি হলো নিউমোনিয়া। গলা-ফুলা রোগে তা নাকের ছিদ্রে ব্যবহার করবে এবং নিউমোনিয়া হলে তা বড়ি বানিয়ে খাবে।
ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেনঃ চন্দন কাঠের অর্থ- তা চূর্ণ করে বড়ি বানিয়ে খাবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উম্মু কায়স বিনত মিহসান (রাঃ)

এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, নবী মুহাম্মদের সময় ভারত জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে ছিল, এবং বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ভারত আসতো। ভারত আসলে তারা নিশ্চিতিভাবে ভারতের সভ্যতার সাথেও পরিচিত ছিল। সেই কারণেই, ভারত আরব অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল একটি অত্যন্ত লোভনীয় জায়গা। নবী মুহাম্মদ একটি সহিহ হাদিসে ভারত আক্রমণকারীদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ নবীর উম্মতদের মধ্যে যারা ভারত আক্রমণ করবে, তারা যতবড় অপরাধই বা পাপীই হোক না কেন, সকল পাপ তাতে মুছে যাবে, এবং তারা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাবে। অথচ, ভারতের সাথে কিন্তু নবী মুহাম্মদের কোন শত্রুতাই ছিল না। ভারতের কেউ কোনদিন নবী মুহাম্মদের পাকা ধানে মইও দেয়নি। এই হাদিসে জিহাদ বলতে তাই আক্রমণাত্মক জিহাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। আসুন হাদিসটি পড়ে নিই,

সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২৫/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ৪১. হিন্দুস্থানের জিহাদ
৩১৭৮. মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আব্দুর রহীম (রহঃ) … রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের দুটি দল আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে জাহান্নাম হতে পবিত্রাণ দান করবেন, একদল যারা হিন্দুস্থানের জিহাদ করবে, আর একদল যারা ঈসা ইবন মারিয়াম (আঃ) এর সঙ্গে থাকবে।
তাহক্বীকঃ সহীহ। সহীহাহ ১৯৩৪, সহীহ জামে’ আস-সগীর ৪০১২।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সাওবান (রাঃ)

একইরকম বক্তব্য বর্ণিত আছে নুআইম বিন হাম্মাদের হাদিস সংকলন গ্রন্থে। যদিও এই হাদিস গ্রন্থে অনেক সমস্যা থাকার কথা ইসলামি আলেমগণ বলে থাকেন, কিন্তু একই বক্তব্য যেহেতু অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও পাওয়া যায়, তাই এই হাদিসগুলোকে সঠিক হিসেবেই গণ্য করতে হয় [1]

ভারতে
খিলজি 2

প্রাচীন বঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর তক্ষশীলা কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। টলেমির ভূগোলে তক্ষশীলাকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘তক্ষিয়ালা’ (Taxiala) হিসেবে[2]। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাঠদান করা হতো না। কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্র এখানে রচনা করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে। রাজা বিম্বিসার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবক এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন। এই স্থান তৎকালীন বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়নস্থল। পরবর্তী সময়কার বিভিন্ন লেখায় ছড়ানো ছিটানো সূত্র থেকে জানা যায় যে, তক্ষশীলার সূচনা সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে হয়েছিল। ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত নালন্দাও প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সমাদৃত ছিল। ৫ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্র ছিল, যা সারা বৌদ্ধ বিশ্বের ছাত্র এবং পণ্ডিতদের আকর্ষণ করতো। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫ম শতাব্দীতে বৌদ্ধ শিক্ষার অধ্যয়নের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি এশিয়ার উচ্চ শিক্ষার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত ছিল। নালন্দা ছিল পণ্ডিত এবং ছাত্রদের একটি বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ের আবাসস্থল যারা চীন, তিব্বত এবং মধ্য এশিয়া থেকে তার প্রখ্যাত শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়ন করতে এসেছিল। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার ছিল দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, বরং চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে প্রাচীন বাঙলা এবং গোটা বিশ্বেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।

আরো একটি তথ্য যা অনেকেই জানেন না সেটি হচ্ছে, নালন্দা মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্ম নেয়া মহাপণ্ডিত মহাস্থবির শীলভদ্র। তিনি ছিলেন বৌদ্ধশাস্ত্রের একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি ও সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। তিনি বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ও সন্ন্যাসী হিউয়েন সাঙের সরাসরি শিক্ষকও ছিলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি ছিল এর বিশাল গ্রন্থাগার, যা ‘ধর্মগঞ্জ’ (‘ধর্মের হাট’) নামে পরিচিত ছিল। তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এই গ্রন্থাগারটি অবস্থিত ছিল। ভবনগুলির নাম ছিল ‘রত্নসাগর’ (‘রত্নের মহাসাগর’), ‘রত্নোদধি’ (‘রত্নের সমুদ্র’) ও ‘রত্নরঞ্জক’ (‘রত্নখচিত’)। রত্নোদধি ছিল নয়টি তলবিশিষ্ট ভবন। এখানেই পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ও গুহ্যসমাজ রক্ষিত ছিল।। লাইব্রেরিটিতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের কয়েক হাজার ভলিউম, সেইসাথে অন্যান্য বিষয়ের বিস্তৃত পরিসরের পাঠ্যপুস্তক ছিল বলে জানা যায়। লাইব্রেরিটি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে খ্রিস্টীয় ১২শতকে আক্রমণকারী তুর্কি মুসলিম সেনাবাহিনী কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন পুড়িয়ে দেয়া হয়, কয়েক মাস ধরে সেই বই পুড়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীই ধ্বংস করেন, এরকম সরাসরি প্রমাণ পাওয়া না গেলেও, আশেপাশে যেসকল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেসব স্থানে খিলজির আক্রমণ এবং ধ্বংসের দলিল প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলা ও মগধে পাল রাজাদের আমলে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠে, যার মধ্যে পাঁচটি মহাবিহারের নাম পাওয়া যায়। মহাবিহারগুলো হলো: বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় (পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাবিদ্যালয়), নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (পৃথিবীর প্রথম আবাসিক মহাবিদ্যালয়, অতীতে গৌরবোজ্জ্বল এবং বর্তমানেও আলোচিত), সোমপুর মহাবিহারওদন্তপুরী ও জগদ্দল। পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ই পরস্পর সংযুক্ত ছিল, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজাদের তত্ত্বাবধানে ছিল এবং বিহারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ ছিল। পাল সাম্রাজ্যের অধীনে পূর্ব ভারতে প্রতিষ্ঠিত আন্তঃসম্পর্কিত বিহার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে একটিমাত্র নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হতো। মহাবিহারগুলোর পণ্ডিতেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারতেন, এমনকি বিখ্যাত পণ্ডিতদের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদবীর ভিত্তিতে স্থানান্তরিত হওয়া সাধারণ ব্যাপার ছিল। নালন্দার মতো ওদন্তপুরীর অধিকাংশ আচার্য ও শিক্ষার্থী বাঙালি ছিলেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে, ১১৯৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী ওদন্তপুরী বিহার আক্রমণ করেন। কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, বখতিয়ার খিলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও ধ্বংস করেন। নালন্দা ও ওদন্তপুরী মহাবিহারের দুরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার তাই নালন্দার ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হয়েছিল বলে ধরা হয়। সেই যুগের অপর দুই বিহার বিক্রমশিলা ও জগদ্দল তুর্কীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। বখতিয়ার খিলজী দুর্গ আক্রমণকালে উঁচু প্রাচীরঘেরা ওদন্তপুরীকে দুর্গ ভেবে ভিক্ষুদের ন্যাড়া মাথা ব্রাহ্মণ ভেবে আক্রমণ করে ধ্বংস করেন এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালান।

বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, নবী মুহাম্মদ ভারত আক্রমণের নির্দেশ তার সাহাবীদের দিয়ে গিয়েছিলেন, এবং ভারত আক্রমণকারীদের জন্য সকল গুনাহ মাফ করে তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়টি খুবই বিপদজনক। কারণ কোন মানুষের কাছে যদি এরকম কোন পন্থা থাকে যে, এই কাজটি করলে তার অতীতের সকল অন্যায় ধুয়ে যাবে, সেটি তার অপরাধবোধকে কমিয়ে দেয়। এই নিয়ে ভবিষ্যতে অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে, আপাতত আমরা খিলজির ভারত আক্রমণ নিয়ে আলোচনা করি।

তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি প্রাথমিক জীবনে ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের গরমশিরের (বর্তমানে দশতে মার্গ) বাসিন্দা ছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ খুঁজতে থাকেন। তারপরে তিনি হিজবার উদ্দিনের অধীনে একটি চাকরি পান, তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে এবং দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য তিনি ভারত আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিহার ও বঙ্গ আক্রমণ ও জয় করেন। আরও লোভী হয়ে তিনি তিব্বত আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার সেনাবাহিনী নিয়ে তিব্বত আক্রমণ করেন। তার তিব্বতি অভিযান ব্যর্থ হয় এবং সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। তখন প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে থাকে। গণহত্যা ও পরাজয়ের শোকে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজ ই সিরাজের মতে, আলী মর্দান খলজির ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হন।

মিনহাজ আল-সিরাজ জুজজানি (জন্মঃ ১১৯৩) এর পূর্ণ নাম আবু উসমান মিনহাজউদ্দিন বিন সিরাজউদ্দিন। তিনি ছিলেন ১৩শ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ। তার লিখিত তবকাত-ই-নাসিরী মিনহাজ-ই-সিরাজ জুর্জানি মধ্যযুগের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ। এ গ্রন্থে ইসলামের বিভিন্ন নবী-রসুলের ইতিহাস থেকে শুরু করে মিনহাজ তার নিজের সময় পর্যন্ত ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। বাংলা মুলুকে মুসলিম শাসনের প্রথম ৫০ বছরের ইতিহাস একমাত্র এ গ্রন্থেই পাওয়া যায়।

ঘোরের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত জুর্জান ছিল মিনহাজের পরিবারের আদি নিবাস। তার পিতা ঘোরী সুলতানদের অধীনে কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। ৩৪ বছর বয়সে মিনহাজ ভারতে আসেন। সমসাময়িক মানদন্ডে তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং তাঁর কিছু কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাও ছিল। তিনি প্রথমে উচ্চ-এ নাসিরুদ্দীন কুবাচার দরবারে যোগদান করেন। কুবাচা তাকে কাজী পদে নিযুক্তি দেন। কুবাচার নিকট থেকে শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ মুলতান দখল করে নিলে মিনহাজ দিল্লিতে চলে আসেন। দিল্লিতে মিনহাজ একাধারে ইমাম, কাজী, খতিব প্রভৃতি পদে অধিষ্ঠিত হন ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দিল্লি সুলতানদের সাহচর্যে আসেন এবং মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, ইমাম, খতিব, কাজী ও সদর-ই-জাহান পদে নিয়োগ লাভ করেন। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের রাজত্বকালে দিল্লির কাজী থাকা অবস্থায় তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরী রচনা করেন এবং ক্ষমতাসীন সুলতানের নামে এটি উৎসর্গীকৃত হয়।

বখতিয়ার খিলজীর বিজয় থেকে শুরু করে ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হলো তবকাত-ই-নাসিরী। অন্যান্য সমসাময়িক উৎস হিসেবে কিছু শিলালিপি ও মুদ্রা পাওয়া যায়। শুধু সমসাময়িক গ্রন্থ বলে নয়, অন্য আরও দুটি কারণে গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মিনহাজ স্বয়ং বাংলায় আসেন, দুবছরের মতো এখানে অবস্থান করে তাঁর রচনার জন্য তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং এখানকার রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহেও অংশ নেন। দ্বিতীয়ত, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তিনি তাঁর গ্রন্থের সম্পূর্ণ এক অধ্যায় জুড়ে (তবকাত) বর্ণনা করেন। বাংলার রাজধানীতে অবস্থানকালে তিনি বখতিয়ারের বাংলা বিজয় সম্পর্কে তাঁর বেঁচে থাকা সহযোগীদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। দিল্লি সুলতানদের বাংলায় অভিযান কালে আসা দিল্লিবাসীদের নিকট হতে তথ্য সংগ্রহ করেও তিনি ইতিহাস রচনার কাজে লাগান। বাংলায় মুসলিম সমাজের বিকাশ সম্বন্ধেও ঐতিহাসিক মিনহাজ তাঁর তবকাত-ই-নাসিরীতে ধারণা দেন। তার তবকাত ই নাসিরী গ্রন্থটি পাঠকদের জন্য দেয়া হচ্ছে। পাঠকগণ ডাউনলোড করে পড়তে পারেন [3]। এই গ্রন্থের কয়েকটি পাতা আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করবো।

প্রথমেই দেখে নিই, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কীভাবে লুটতরাজ চালিয়েছেন এবং মস্তক মুণ্ডিত কথিত ব্রাহ্মণদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছেন। উল্লেখ্য, বইটির লেখক ভুল করে ঐ অঞ্চলের অধিবাসী মস্তক মুণ্ডিত মানুষদের ব্রাহ্মণ ভেবেছিলেন, যদিও তারা ব্রাহ্মণ ছিলেন এরকম প্রমাণ মেলে না। বরঞ্চ এই অধিবাসীগণ বৌদ্ধভিক্ষু ছিল বলেই প্রমাণ মেলে। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও একইরকম মস্তক মুণ্ডিত থাকে [4]

সেই সময়ে এটিও জানা যায়, সমগ্র নগর এবং দূর্গটি মিলে একটি অতি বৃহৎ শিক্ষায়তন ছিল। আধুনিক সময়ের ইউনিভার্সিটির মতই, সেই শিক্ষায়তনটি ছিল পুরো নগজ জুড়ে। প্রাচীন এথেন্স, আলেক্সান্ড্রিয়া বা আধুনিক সময়ের অক্সফোর্ড শহরে গেলে আপনি দেখতে পাবেন, পুরো শহর জুড়েই শিক্ষায়তন। ভাবা যায়, সেই আমলে ভারতে একটি পুরো নগর গড়ে উঠেছিল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদলে? কিন্তু সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিহারে খিলজি নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিলেন [5] –

শুধু গণহত্যাই নয়, বিধর্মী বা কাফেরদের মা বোন স্ত্রী কন্যা সকলকেই তিনি গনিমতের মাল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন [6] –

এত বিপুল সম্পদ তিনি লুটপাট করেন, যা ইতিহাস লেখক ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না। দেখুন, তার লিখিত গ্রন্থ থেকে [7] –

এরপরে শুরু হয় তিব্বত আক্রমণের ঘটনা [8] –

মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি এই সময়ে মানুষের অভিশাপ এবং গালাগালির শিকার হতে শুরু করেন। এত বেশি মানুষের অভিশাপ তিনি পাচ্ছিলেন, যে তিনি এই সময়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যান [9] –

এবারে আসুন, বইটির ইংরেজি অনুবাদ থেকেও খানিকটি অংশ দেখে নেয়া যাক [10] –

খিলজি 14
খিলজি 16

বখতিয়ারের ঘোড়া ও জিহাদী চেতনা

উপরে বর্ণিত হলো বখতিয়ারের নির্মম গণহত্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস, লুটতরাজ এবং নারী শিশুদের গনিমতের মাল হিসেবে দাসদাসীতে পরিণত করার ইতিহাস, ইতিহাসের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিশুকিশোর জানে না বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নাম, জানে না মহাপণ্ডিত মহাস্থবির শীলভদ্রের নাম। তারা কিন্তু খুনী বখতিয়ারের নাম ঠিকই জানে। এই ডাকাতকে আমাদের শিশুদের বইতে একজন বীর হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। এমনকি, ইসলামপন্থী কবি আল মাহমুদ এই খুনী ডাকাতকে নিয়ে কবিতাও লেখে। আসুন সেই কবিতাটি পড়ে দেখি, এবং বোঝার চেষ্টা করি যে, এই ধরণের কবিতা শিশু কিশোরদের মনে জিহাদ, খুনোখুনি,ও রক্তারক্তি আর কাফের হত্যার উৎসাহ দেবে, নাকি এক অসাম্প্রদায়িক মানবিক চিন্তাভাবনার জন্ম দেবে!

বখতিয়ারের ঘোড়া- আল মাহমুদ
—————————————–
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে।
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। 
খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।

মোঘল আমল ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির পূর্বে এবং পরে বহু মুসলিমই ভারত আক্রমণ করেন এবং এটি চলতেই থাকে। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু সেই ঐতিহাসিক বিষয়াদি নয়, বরঞ্চ ইসলামী শরিয়ত এবং অমুসলিমদের সম্পর্কে ইসলামী শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই এই আলোচনায় মূলত ইসলামী আইন নিয়েই পর্যালোচনা করা হবে। ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী বা আল-ফাতাওয়া আল-আলমগিরিয়া বা আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া নামে পরিচিত একটি ইসলামী আইন সংকলন রয়েছে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে এই সংকলন প্রণীত হয়। “ভারতে তৈরি মুসলিম আইনের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন” হিসাবে ঘোষণা করা হয়, সংকলনটি ব্যাপকভাবে ইসলামিক আইনশাস্ত্রের (ফিকহ) ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুসংগঠিত কাজগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। সুন্নি হানাফি মাজহাবের ভিত্তিতে শরিয়া আইন এতে সংকলিত হয়েছে। অনেক আলেম এই গ্রন্থ প্রণয়নে অবদান রেখেছেন। এতে কোরআন, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, জামি’আত-তিরমিযী থেকে সব দলিল গ্রহণ করা হয়েছে।

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *