মুক্তির দিশারী

মুক্তচিন্তার পথ প্রশস্ত করাই আমাদের লক্ষ্য।

দর্শন ধর্ম ধর্মনিরপেক্ষতা ফিকার্ড বিজ্ঞান

ইসলাম এবং বিজ্ঞান শিক্ষার দ্বন্দ্ব

ছোটবেলা থেকেই আমরা স্কুল থেকে পাওয়া অনেক বই খুব আনন্দের সাথে পড়ে পড়ে বড় হই। আমরা অনেক নতুন বিষয় সেইসব বইগুলো থেকে শিখি এবং জানি। সেই বইগুলোর মধ্যে কিছু বই হচ্ছে মানব সভ্যতার ইতিহাস, গুহাযুগে মানুষ কেমন ছিল, এরপরে মানুষ ধীরে ধীরে কীভাবে আগুন আর চাকা আবিষ্কার করলো, অস্ত্র তৈরি শিখলো, যোগাযোগ আর কথা বলার জন্য ধীরে ধীরে ছোট ছোট শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ভাষার আবিষ্কার করলো, সাধারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা ইত্যাদি। সেইসব বই থেকে আমরা আরো নানাবিধ বিষয় জানতে পারি, যেগুলোর অনেককিছুই আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসের পরিপন্থী।

ধরুন, ছোটবেলা থেকে আমরা আমাদের কিছু গুরুজনদের কাছ থেকে জানতাম, রোগব্যাধী হচ্ছে দেবতা বা আল্লাহ ভগবানের শাস্তি। কিন্তু পরে আমরা বই পড়ে জানতে পারি, সেগুলো হচ্ছে নানা ধরণের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা। অথবা মানুষের শারীরিক কোন জটিলতা। বৃষ্টি কীভাবে হয়, বিদ্যুৎ কেন চমকায়, দিনরাত কীভাবে হয়, আকাশের তারাগুলো আসলে কী, এইসবই আমরা সেই বইগুলো থেকে শিখি। ছোটবেলা আমরা ভাবতাম, বা আমাদের দাদাদাদীদের থেকে শুনতাম, সেগুলো সম্পর্কে নানা রূপকথার মুখরোচক গল্প। গল্পগুলো শুনতে ভালোই লাগতো, কিন্তু সেগুলো আসলে গুরুত্ব দেয়ার মত কিছু ছিল না। আমরা আমাদের বিজ্ঞান বইতে যা পড়তাম, দিনশেষে সেগুলোই সঠিক তথ্য বলে ধরে নিতাম। সেই বইগুলোতে যা বলা রয়েছে, সেগুলোই কি শেষ কথা? সেগুলো নিয়েও কি আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি না? সেগুলো কি যাচাই ছাড়াই আমাদের মেনে নিতে হয়? না। সাধারণত আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো, মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা, মহাকাশের নানা নক্ষত্রসমূহ, এইসব কিছুই অসংখ্যবার যাচাই করে দেখার পরেই আমরা জানতে পারি। এবং সেগুলোও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। যাচাই করে যদি সেগুলোর মধ্যে ভুল পাওয়া যায়, সেগুলো ঠিক করে নিতে হয়। এভাবেই আমাদের সভ্যতা এবং জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার চাকা আসলে মানুষের জ্ঞান এবং ক্রমাগত নিজেদের জ্ঞানকে শুধরে নেয়ার ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ কী সেই চাকা স্থবির করে দেয়? আমাদের স্কুল কলেজ মাদ্রাসাগুলোতে আসলে কী পড়ানো হয়? সেই সব ইসলামিক গ্রন্থগুলো থেকে আমাদের শিশুরা কী শিখছে? তারা এইসব মধ্যযুগীয় গ্রন্থ পড়ে আজকে আমরা সেগুলোই বিচার বিশ্লেষণ করে দেখবো। উল্লেখ্য, ধর্ম হিসেবে ইসলাম তার নিয়মাবলী এবং বিশ্বাসের বিষয়গুলোকে যাচাই করার কোন সুযোগ দেয় না, বরঞ্চ যাচাই করতে নিরুৎসাহিত করে। এই বিষয়ে বিস্তারিত অন্যত্র লেখা হয়েছে, এই লেখাতে সেগুলো তাই আলোচনা করা হচ্ছে না [1]


ধর্ম ও বিজ্ঞানের মৌলিক দ্বন্দ্ব

ধর্মের মূল স্তম্ভ হলো বিশ্বাস, সত্যিকার অর্থে ধর্মের মৌলিক বিষয়াদি অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। একজন ধার্মিকের জন্য ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় বিধিবিধান সবকিছুই অবিচল আস্থার সাথে মেনে চলতে হয়, কোনো ধরণের প্রশ্ন তোলা বা সন্দেহ প্রকাশ করা সেখানে মহাপাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কারণে ধর্মীয় শাস্ত্রের প্রতিটি বক্তব্যকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়, এবং যে কোনো প্রকার সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশকে কঠোর শাস্তির আওতায় ফেলা হয়। কোন ধরণের যাচাই বাছাই অথবা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা মানেই বিশ্বাসটি দুর্বল হয়ে যাওয়া। একজন ধার্মিক কোন অবস্থাতেই তার ধর্ম সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহ করার অধিকার রাখে না। মনে যদি সন্দেহ বা সংশয়ের সৃষ্টি হয় তাহলে সেটিকে ধর্মগুলো মহাপাপ হিসেবে গণ্য করে। একজন ধার্মিককে তার ধর্মের ভুল চোখের সামনে তুলে ধরলেও সে মানতে চাইবে না। সে নানা ধরণের কুযুক্তি এবং ভুল তথ্য দিয়ে তার ধর্মকে সঠিক বলে চালাবার চেষ্টা করবে। আর কেউ যদি ধর্মের ভুল মানুষের কাছে প্রকাশ করে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধানও ধর্ম করে রেখেছে। ইসলামে এই ধরনের শাস্তির উদাহরণ হলো ধর্মত্যাগীদের (মুরতাদ) মৃত্যুদণ্ডের বিধান, যেখানে কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে বা ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা, এমনকি হত্যার মতো চরম শাস্তি প্রদান করাও বৈধতা লাভ করে। এই ধরনের শাস্তি শুধুমাত্র ইসলামেই নয়, অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলোতেও বিদ্যমান, যেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ বা ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে দেখা যায়, ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা, কোনো প্রকার যুক্তি, তথ্য বা প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং একধরনের অন্ধ ভক্তি এবং মেনে নেওয়ার মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে।

অন্যদিকে, বিজ্ঞানের জগতে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞান শুধুমাত্র যুক্তি, প্রমাণ, পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা, যাচাই করা এবং প্রমাণিত ভুলকে সংশোধন করা বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব। একজন গবেষক চাইলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, নিউটনের গতির সূত্র বা ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, এবং প্রমাণ করতে পারলে তাকে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত করা হবে। এমনকি, এই ধরনের গবেষণার জন্য তাকে নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হতে পারে। কারণ, বিজ্ঞান কখনোই কারও প্রতি অন্ধ ভক্তির দাবি করে না, বরং যেকোনো তত্ত্ব বা ধারণা প্রমাণের ভিত্তিতে নির্ণীত হয় এবং প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বিজ্ঞান একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিনিয়ত পুরনো ধারণা ও তত্ত্বগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সামনে আসে। বিজ্ঞান এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে সংশয়, সন্দেহ এবং অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করা হয়, কারণ এর মাধ্যমেই জ্ঞানের সত্যিকারের অগ্রগতি সম্ভব। ফলে, ধর্ম যেখানে বিশ্বাসের ভিত্তিতে নির্ভরশীল এবং যে কোনো প্রকার সংশয়কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করে, সেখানে বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে যুক্তি, তথ্য এবং প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই কারণেই, ধর্ম এবং বিজ্ঞান মৌলিকভাবে একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে—একটি অবিচল অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক, আরেকটি সন্দেহ ও যুক্তির বিকাশের চূড়ান্ত উদাহরণ।

যেকোন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিষয়ে আপনি সন্দেহ সংশয় যাচাই বাছাই করতে পারেন। এমনকি, কোন মহাবিজ্ঞানীর কোন যুগশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আপনি চ্যালেঞ্জও করতে পারেন। কারণ বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোন স্থানই নেই। বিজ্ঞান কাজ করে যুক্তি তথ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই এবং পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে। আপনাকে এরকম বলা হবে না যে, নিউটনের প্রতি ভক্তি স্বরূপ তার সব কথাকে বিশ্বাস করতে হবে, বা নিউটনের সমালোচনা শাতিমে নিউটন বলে গণ্য হবে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! হেফাজতে বিজ্ঞান নামে একটি সংগঠন আপনার ফাঁসিও চাইবে না। বরঞ্চ বিজ্ঞানীদের সংগঠনগুলো আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।


পার্থিব জ্ঞান সম্পর্কে ইসলাম

বিজ্ঞান হচ্ছে মূলত পদ্ধতিগত ও বিধিবদ্ধ পার্থিব জ্ঞানের সমষ্টি, যার প্রধান উদ্দেশ্য সত্য জানা এবং পার্থিব সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করা, মানুষের পার্থিব স্বার্থ রক্ষা করা। যেমন ধরুন, একটি রোগ এবং তার ঔষধ নিয়ে বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করেন পার্থিব জীবনে মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই। ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। একইসাথে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা প্রশাখাই আসলে পার্থিব জীবনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট; মানুষের ক্ষুধা, রোগব্যাধি অথবা মানুষের পার্থিব জীবনকে সহজ করে তোলার জন্য। পার্থিব বিষয়াদিই বিজ্ঞানে মুখ্য, পারলৌকিক কোন বিষয় বা আল্লাহর সন্তুষ্টি বিজ্ঞানের কোন ধর্তব্যের বিষয়ই নয়।

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *