ভূমিকা
ইদানিং অনেক মুসলিমকে বলতে শোনা যায়, তারা নাকি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে এরপরে অনেক গবেষণা এবং যাচাই বাছাই করে ইসলামের সত্যতা বুঝতে পেরেছে। একই কথা অনেক বিতর্কের সময় ধার্মিক হিন্দুরাও বলে থাকেন যে, তারাও নাকি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়ে খুব যাচাই বাছাই করে, গবেষণা করে এরপরেই হিন্দু ধর্মের সত্যতা বুঝতে পেরেছে। খ্রিস্টান ইহুদি বৌদ্ধ সকলেরই একই কথা। বেশিরভাগ মানুষই যাচাই বাছাই গবেষনা করেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মটির সত্যতাই আবিষ্কার করেন। বিষয়টি একইসাথে হাস্যকর এবং মর্মান্তিক। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে কগনিটিভ বায়াস কাকে বলে, তা খানিকটা আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন।
কগনিটিভ বায়াস অর্থ হচ্ছে জ্ঞানীয় পক্ষপাত যা আসলে আরোহী যুক্তির একটি পদ্ধতিগত ভুল। মানুষের আবেগ, পূর্ব থেকে নিয়ে আসা বিশ্বাস, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম, ছোটবেলা থেকে শিখে আসা সংস্কার, এইসবই তার সামনে থাকা তথ্যপ্রমাণগুলোর মধ্যে গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ সে যা শুনতে চায়, যা শুনলে সে আনন্দিত হয়, যা তার বিশ্বাসকে স্বস্তি দেয়, সেই ধরণের তথ্য প্রমাণ সম্পর্কে অবচেতনভাবেই তার পক্ষপাত। একজন ব্যক্তি যখন বিষয়ীগতভাবে তথ্য সংগ্রহ বা স্মরণ রাখে, তখন তার পূর্ব ধারণা বা সংস্কার বা বিশ্বাসের সাথে যা মিলে যায়, সেই সব তথ্যের প্রতি তার এক ধরণের পক্ষপাত থাকে। তার মধ্যে তাড়না থাকে যে, সে যেই মতবাদ বা বিশ্বাস লালন করে, সেগুলো যেন সত্য প্রমাণ করা যায়। শুধুমাত্র সেইসবের পক্ষে থাকা তথ্যপ্রমাণই তার কাছে সত্যিকারের তথ্যপ্রমাণ বলে মনে হয়। অপরদিকে, যেসব তথ্য প্রমাণ তার মতবাদ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তা যত শক্তিশালী বা স্পষ্টই হোক না কেন, সে সেগুলো এড়িয়ে যায় বা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে। তথ্যপ্রমাণ থেকে যতটুকু তার পক্ষে গেছে, সেগুলো সে কাজে লাগায় এবং মনে রাখে তার বিশ্বাস বা মতবাদকে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই প্রবণতাটিই হলো ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা ‘কগনিটিভ বায়াস‘, যা একটি ভুল পদ্ধতি।
বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছেন যে, মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটি প্যাটার্ন রিকগনাইজিং মেশিন। অর্থাৎ সে প্রতিনিয়ত প্যাটার্ন খোঁজে। সে যখন মেঘের দিকে তাকায়, সে মাঝে মাঝেই ঘোড়া, হাতি কিংবা কোন মানুষকে দেখতে পায়। কিন্তু সেই মেঘটি হয়তো আদতে কোন ঘোড়া বা হাতি বা মানুষের মত আকৃতির নয়। কিন্তু তার মস্তিষ্ক যেহেতু প্যাটার্ন খোঁজে, সে মেঘের মধ্যে এরকম কিছু না কিছু বের করেই ফেলে। একইভাবে, মস্তিষ্ক সবসময় আপনার বিশ্বাসকে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেই সব স্মৃতি আপনাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, যা আপনাকে আনন্দ দেয়। এই আনন্দটুকু পেলে আপনার মন ভাল হয়ে যায়, সেই প্রক্রিয়াটি বুঝতে পেরে আপনার মগজ কাজটি বারবার করে, নিজেকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টায়। এই কারণে, আপনি যখন অনেকগুলো তথ্যপ্রমাণ পড়েন, তার মধ্যে সেইগুলোই আপনার মস্তিষ্কে বেশি বেশি বার এক্সেস হয়, যেই সব স্মৃতি আপনি বারবার মনে করেছেন। আর এই কারণেই আপনার ভেতরে কনফার্মেশন বায়াসের উদ্ভব ঘটে।
যাইহোক, আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, ইসলাম কী আসলে অন্য ধর্মসমূহ যাচাই বাছাই করে, যুক্তি বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে সঠিক ধর্মটি বেছে নেয়ার অনুমতি দেয় কিনা।
পারিবারিক ধর্ম
আমরা প্রায় সব মানুষই কোন একটি পরিবারে জন্ম নিই। স্বাভাবিকভাবেই, সেই পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই আমরা বড় হয়ে উঠি। বাবা মা যদি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহই একমাত্র ঈশ্বর, কোরআনই একমাত্র সত্য, তাহলে সেইসব বিশ্বাস করেই বড় হই। বাবা মা যদি হিন্দু হয়, আমরাও হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস নিয়ে বড় হই। তারা যেই ধর্মের শিক্ষাই আমাদের দেন, সেই শিক্ষা নিয়েই আমাদের মন মানসিকতা গড়ে ওঠে। ঈশ্বর সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা উনারাই বেশ ভালভাবে তৈরি করে দেন। ঈশ্বরের কেমন হওয়া উচিৎ, ঈশ্বরের মূর্তি থাকা উচিৎ কী অনুচিত, ঈশ্বর একজন নাকি একাধিকজন, ধর্মে কী থাকা উচিৎ, সেইসব বিষয়ে সবচাইতে বেইসিক ধারণা আমরা পাই পরিবার থেকেই। এরপরে এলাকার বন্ধুরা, আত্মীয় স্বজন, নানানানী দাদাদাদী চাচাচাচী মামামামী, এরা আমাদের নানান ধর্মীয় গল্পকেচ্ছা বলে। স্কুলের শিক্ষকগণ আমাদের ধর্মের বিভিন্ন ব্যক্তির গল্প বলেন। এই সবের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের ধারনা তৈরি হয়। বাঙলাদেশে একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকলে আশেপাশের সবাই একজনকে ইসলাম ধর্মের সত্যতা সম্পর্কেই বলবে, এবং অন্য ধর্মগুলো যে কত মিথ্যা আর বিকৃত সেটিই বলবে। ভারতে হিন্দু পরিবারে জন্ম নিলে এবং হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকলে আশপাশের সবাই হিন্দু ধর্ম যে কত পুরনো এবং সঠিক, সেটিই বলবে। এরকম সবদেশেরই একই চিত্র।
একইভাবে, কোন দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সংবাদপত্র, রেডিও টিভি ইত্যাদিতেও মুসলিমদের পছন্দের নাটক সিনেমা প্রচারিত হবে। আবার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে টিভিতে প্রচার হবে রামায়ন বা মহাভারত। খ্রিষ্টান বা ইহুদী বা বৌদ্ধদের দেশেও একই অবস্থা। এসব দেখে শুনে বড় হতে হতে এই বিষয়গুলোকেই একজন মানুষ সত্য মনে করে বড় হবে। ছোটবেলার শিক্ষা মানুষের মনে খুব গভীর প্রভাব ফেলে। ছোটবেলায় শেখা খুব সাধারণ জিনিসও আমরা বহুকাল মনে রাখি।
আশপাশের মোটামুটি সবাই যদি আমাদের শেখান যে, দেবদেবী আছে, আমরা সেইভাবেই চিন্তা করতে শিখি। তারা যদি আমাদের শেখান আল্লাহ বা যীহোভা আছে, আমাদেরও সেইগুলোই সত্য বলে মনে হয়। তারা যদি ছোটবেলা থেকে আমাদের মূর্তি পুজা করতে শেখান, সেই কাজটিই আমাদের কাজে যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক মনে হয়। তখন যদি আমাদের মুসলিম বন্ধুরা আমাদের বলে, তাদের আল্লাহকে দেখাই যায় না, তখন আমাদের খুব হাসি পায়। মনে হয়, এ আবার কেমন ঈশ্বর রে বাবা, দেখাই যায় না। নাই ঈশ্বরকে আবার কেমন পুজা?
আবার, আমরা যদি মুসলিম পরিবারে জন্ম নিই, আমাদের ধারনা দেয়া হয় যে, ঈশ্বর বা আল্লাহকে কেউ দেখতে পায় না। তখন আমাদের হিন্দু বন্ধুরা যখন দেবদেবীর ছবি আমাদের দেখায়, বা আমরা কোথাও মূর্তি দেখি, আমাদের খুব হাসি পায়। মনে মনে বলি, এ আবার কেমন ঈশ্বর রে বাবা, এদের ঈশ্বরকে আবার দেখা যায়। এদের চারটা হাত, দুইটা মাথা, কারো কারো আবার হাতির মাথা, কী হাস্যকর! এই ঈশ্বরগুলো তো একদমই মানুষের মত, বা জীবজন্তুর মত। হাতির মাথা ওয়ালা তো ছাড়, কয়েকটা আরো বেশি উদ্ভট দেখতে। দশ হাত তিন মাথা, এগুলো কী উদ্ভট ধর্ম রে বাবা।
কিন্তু এই আমরাই যদি ঘটনাক্রমে ঐ ধর্মের পরিবারে জন্ম নিতাম, তাহলে আমাদের ছোটবেলা থেকে সেই শিক্ষাটিই দেয়া হতো। এবং সেগুলোই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। যেমন ধরুন, আমি একটি বাঙালি পরিবারে জন্ম নিয়েছি। আমার কাছে বাঙলা ভাষাটা খুবই সহজ এবং এরকম ভাষাকেই আমার মনে হয় দারুন! যখন জার্মান ভাষা শিখতে শুর করলাম, তখন মনে হতো, কী উদ্ভট ভাষা রে বাবা! আবার একজন জার্মানও যখন বাঙলা ভাষা শিখতে যাবে, তার কাছেও ঐ ভাষাটি উদ্ভট মনে হতে পারে। আবার ধরুন, আমাদের সংস্কৃতিতে ঈদের দিনে পাঞ্জাবি পড়ে অন্য বাসায় বেড়াতে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অন্য দেশের বা অন্য সংস্কৃতিতে আবার এইরকম উৎসবের দিনে মানুষ রাস্তায় নেমে নাচগান করে। ঐসব দেখলে আমাদের উদ্ভট মনে হয়। আবার, তারা যখন আমাদের আচার আচরণ দেখে, তাদের কাছেও সেটি উদ্ভট মনে হয়। এসবের কারণ হচ্ছে, ছোটবেলা থেকে আমরা যেই পরিবেশে বড় হই, সেই সংস্কৃতিই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়।
মাঝে মাঝে আমাদের মনে ধর্ম বিষয়ে নানা প্রশ্ন জাগে। আমরা আমাদের ধর্মেরই কোন না কোন ধর্মগুরু, কিংবা স্কুলের শিক্ষক অথবা গুরুজনদের সেই নিয়ে প্রশ্ন করি। উত্তর আসলে যেমনই হোক, সন্তোষজনক অথবা অযৌক্তিক, আমাদের মেনে নিতে হয়। তারা আমাদের নানাভাবে মিথ্যা বলে, নানা গোঁজামিল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেন, ধর্মে যা আছে সেটিই সঠিক। যেমন ধরুন, আমরা যদি হিন্দু ধর্মে জন্মগ্রহণ করি, এবং মূর্তি পুজা করি, মন্দিরে যাই, মাঝেমাঝে ভিন্ন ধর্মের লোক এসে আমাদের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দিয়ে যায়। তখন আমাদের প্রশ্ন জাগে, এইসব মূর্তি, যা আমরা পুজা করি, সেগুলোর আসলেই কি কোন ক্ষমতা আছে? ক্ষমতা থাকলে বিধর্মীরা আমাদের মুর্তি এবং মন্দির ভেঙ্গে দিয়ে গেল কীভাবে? তখন আমাদের ধর্মগুরুরা নানা গোঁজামিল দিয়ে আমাদের বুঝ দেয়। অযৌক্তিক হলেও সেই কথাগুলোই আমাদের মেনে নিতে হয়।
আবার আমরা যদি মুসলিম বা খ্রীষ্টান ধর্মের পরিবারে জন্ম নিই, মাঝে মাঝে বিধর্মীরা আমাদের মসজিদ ভেঙ্গে দিয়ে যায়, কোরআন পুড়িয়ে দিয়ে যায়। এমনকি, কাবা শরীফেও অনেকবার আক্রমণ হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় কাবা শরীফ ধ্বংসের ঘটনাও ঘটেছে। তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কী আল্লাহর কোন ক্ষমতা আছে? ক্ষমতা থাকলে এগুলো হয় কীভাবে? আমরা সেইসব প্রশ্ন নিয়ে ধর্মগুরুদের কাছে গেলে, তারাও ঠিক একইভাবে ভুংভাং দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দেন। কথাগুলো যত অযৌক্তিকই হোক না কেন, যেহেতু ধর্মগুরুরা এগুলো বলেছে, আমাদের মেনে নেয়া ছাড়া আসলে আর কোন পথ থাকে না।
এর মানে হচ্ছে, আমরা আসলে যেই পরিবারে জন্ম নিই, বেশিরভাগ সময়ই ঘুরে ফিরে আমাদের সেই ধর্মের অনুশাসনই মানতে হয়, অথবা আমরা মানতে বাধ্য হয়। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, বা নাস্তিক হয়ে যায়। এটি ইসলামের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, অন্য ধর্মের বেলাতেও সত্য।